"হ্যালো, দীপকদা?"


"হ্যালো, দীপকদা?"

বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন গলার স্বরে ঠিক এই প্রশ্নটির সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। একদিন পড়তে বসছি। টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছি ইয়া মোটা মোটা ফিজিক্স বই দুটো, চার-পাঁচটা নোটসের খাতা, রংবেরংয়ের পেন, হাইলাইটার— মানে গুচ্ছের জিনিস যা আদৌ লাগবে না তবে গুছিয়ে রাখছি যাতে সময়টা ফাঁকি মারা যায় আর কি! চেয়ারে সবে বসেছি সুবোধ বালিকার মতো। বেজে উঠলো ওঘরে রাখা ফোনটা।
"টিং টিং টিং টিং..."
আওয়াজে লাফিয়ে উঠতে হলো। ছুটে গিয়ে ধরলাম ফোনটা।
"হ্যালো?"
একটা খসখসে ছেলে গলা বলে উঠলো, "হ্যালো, কে বলছেন?"
আজব তো! আমাকে ফোন করে আমাকেই জিজ্ঞেস করছে আমি কে!
"আপনি কাকে চান?"
কিছু মিনিটের স্তব্ধতা...
তারপর কাটা কাটা গলায় ভেসে এলো "... লো?... হ্যা... লো? হ্যালো, দীপকদা?"
"না, রং নাম্বার।"
— বলে কেটে দিলাম ফোনটা। এইরকম কাটা কাটা সিগনালের মধ্যে আমাদের প্রথম মোলাকাত। তখন কি আর বুঝেছিলাম, এ একটা যাত্রার শুরু মাত্র।


তারপর অগুনতি বার এই প্রশ্ন আমায় করা হয়েছে। তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে কিছু ' হাইলাইট' আপনাদের বলি।

এই ঘটনাটি বলার আগে বলি আমার ফোনের কথা। ফোনটি একটি স্মার্টফোন— খুব দামী নয়, তবে খুবই প্রিয়। তাতে সেটিং আছে— সাইলেন্ট মোড থাকলে কেউ দুবারের বেশি পর পর ফোন করলে আপনাআপনি ফোনটা বেজে ওঠে। পড়তে গেলে আমি সেই সেটিংএ রাখি যাতে উটকো লোক না বিরক্ত করে অথচ আর্জেন্ট কিছু হলে জানাতেও পারে। তো বসে আছি টিউশন ক্লাসে। স্যার গুরুগম্ভীর কিসব বোঝাচ্ছেন। ক্লাস ছুটির টাইম পেরিয়ে গেছে। আমরা সবাই স্যারের বাণীগুলো লোফার চেষ্টা করছি। হঠাৎ... 
"টিং টিং টিং টিং..."
আমি হন্তদন্ত হয়ে স্যারকে বললাম, "ধরবো স্যার? মা বোধহয়।" স্যার কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েই অনুমতি দিলেন। ফোনে দেখি একটি অচেনা নাম্বার। স্যারের অনুমতি নিয়েছি যখন ফোনটা ধরতেই হলো।
"হ্যালো?"
একটি সুরেলা বাচ্চার গলা, "হ্যালো, দীপক কাকু?"
আমি স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে অসারে বললাম, "হ্যাঁ মা, বেরিয়ে ফোন করবো।"
রেখে দিলাম ফোনটা। খুব বিরক্ত লাগলো। আবার খারাপও লাগলো। না জানি কি দরকারে বাচ্চাটা খুঁজছিল দীপক কাকু কে। আর ফোন করেনি সে। আশা করি তার দরকার মিটেছিল।


আপনারা আবার ভাববেন না যে আমি খুব পড়াকু, তাই সব গল্পেই পড়াশোনা। ওটা কাকতালীয়। এরপরের ঘটনাটা  সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যাবেলার। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা হয়ে রয়েছে। ওরা বলেছে আমার পাড়ায় এসে ফোন করবে। ফোনটা চার্জ হতে দিয়ে সাজছি। ফুল চার্জ দরকার কারণ যা সেলফি উঠবে— হু হু করে সব চার্জ ফিনিশ! তখনই বাজলো ফোন—
"টিং টিং টিং টিং... "
বন্ধুদের কেউ গার্ডিয়ানের ফোন নিয়ে এসেছে ভেবে অচেনা নাম্বার সত্বেও ফোনটা ধরলাম। খটকা লেগেছিল, বন্ধুরা ঠিক সময়মতো চলে এসেছে সেটা ভেবে। যাই হোক, ফোনটা কানে নিতেই আমি বললাম,
"হ্যা–”
"হ্যালো, দিপকদা?"
—দ্রুতবেগে একটি মহিলার গলার স্বর। ভাবটা ঠিক যেনো তোমার স্কুলের ম্যাম তোমার মাকে বলছে, " আপনার মেয়ে স্কুলে পরিষ্কার জুতো পড়ে যায় না কেনো?"
আমি বললাম, "না, রং–”
"এটা তো দীপকদারই নম্বর!"
এত জোর দিয়ে কেউ "সূর্য পশ্চিমে ওঠে।" বললেও আমি বিশ্বাস করে নেবো। 
অগ্যতা বললাম, " ও আচ্ছা। তাহলে ধরুন, ডাকছি।"
হোল্ড টিপে দিয়ে আমি চলে এলাম আয়নার সামনে। চুল বাঁধলাম, আই লাইনার পড়লাম, লিপস্টিক পড়লাম ও ব্যাগে জলের বোতল ধরানোর বিফল চেষ্টা করলাম। এতক্ষণে আবার ফোন এলো। স্ক্রীনে ভেসে উঠলো নাম "সৃজা"। ফোনটা ধরতেই হাসি চাপা গলায় টিটকিরি এলো, " কিরে, কার সাথে এত কথা বলছিস? আমাদের কথা তো ভুলেই গেছিস !" বান্ধবীদের হাসির রোল ফোনের স্পিকার দিয়ে ভেসে এলো।
"ও তোরা এসে গেছিস? দাড়া যাচ্ছি।"
"ওরে পাঁচ মিনিটের বেশি তোর নাম্বার ব্যস্ত কেনো! বলি, প্রেম-টেম করছিস নাকি?"
"না না, এবারে মহিলাকণ্ঠি "হ্যালো, দীপকদা?"। দাড়া গিয়ে বলছি।"


এইভাবেই এই প্রশ্নটি নিয়ে আমার নানা স্মৃতি তৈরি হয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা মিশ্র, যাকে বলে 'bittersweet'। কিছু পরিস্থিতিতে রাগ হয়েছে, বিরক্তি হয়েছে। আবার কিছু পরিস্থিতি খুবই মজার। এখন দিনে অন্তত একবার কেউ দীপকদার খোঁজ না নিলে দিনটা খুব ফাঁকা লাগে। তবে একটা ইচ্ছে আমার আছে, যা পূরণ করার সাহস আমার হয়নি এখনও। আমার সেই ইচ্ছেপূরণের কথোকথনটি হবে ঠিক এইভাবে—
"টিং টিং টিং টিং... "
"হ্যালো?"
"হ্যালো, দীপকদা?"
"সে কি, আপনি শোনেননি? উনি তো মারা গেছেন। আমি ওনার শ্রাদ্ধের মালা কিনতে যাচ্ছি। ফিরে এসে আপনাকে সব জানাচ্ছি।"
 

—সমাপ্ত—

Comments

  1. The ending is hilarious, good quality writing, love for the writer👏👏

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

6 activities to celebrate Earth Day at home🌏

The Wait

Social Media During The Pandemic